ইসলামে পাত্র-পাত্রী দেখার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৬:৩৪ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৯ বুধবার
ছেলে মেয়ে বড় হলে অভিভাবকরা আরো সতর্ক হয়ে থাকেন। প্রত্যেক পিতা-মাতাই চায় তার ছেলে-মেয়েকে উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে বিয়ে দিতে।
কিন্তু পাত্র-পাত্রীর পছন্দের ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকের প্রবণতা হলো, পাত্রী লম্বা ও সুন্দরী হওয়া আর পাত্র ধনী বাবার সন্তান হওয়া; সঙ্গে পাত্র দেখতে স্মার্ট হলে তো আর কোনো কথাই নেই। বাকি গুণাগুণ কিছুটা কম থাকলেও তেমন যায় আসে না। অথচ এই দু’টিই ইসলামে তেমন দেখার বিষয় নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হলো আখলাক চরিত্র ও দীনদারী।
দীনদার পাত্র-পাত্রী খোঁজা:
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাত্র-পাত্রীর দীনদারীর দিকে লক্ষ করা। রাসূল (সা.) পাত্র-পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়ের নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ চার বিষয় বিবেচনা করে কোনো মেয়েকে বিবাহ করা হয়। তা হলো- বংশ, সম্পদ, সৌন্দর্য ও দীনদারী। হে লোকসকল! তোমরা দীনদার মেয়েকে বিবাহ করবে। (মুসন্নাফে ইবনে আব্দির রাজ্জাক) কোনো বর্ণনায় এসেছে, ‘দীনদারীকে প্রাধান্য দিবে, অন্যথায় তোমার দুহাত ধ্বংস হোক।’
তেমনিভাবে রাসূল (সা.) পাত্র পছন্দের ক্ষেত্রে, পাত্রের দীনদারী ও আখলাক চরিত্রকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কাছে পছন্দের দীনদার ও চরিত্রবান পাত্র থাকলে, তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। অন্যথায়, দুনিয়াতে ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা বিস্তার লাভ করবে। কোনো কোনো বর্ণনায় আমানতদার ও চরিত্রবান পাত্রের কথা এসেছে। (মুসন্নাফে ইবনে আব্দির রাজ্জাক)
দীনদার পাত্র-পাত্রী খোঁজার কারণ:
বিবাহের যে সকল লক্ষ-উদ্দেশ্য রয়েছে, তার অধিকাংশের বাস্তবায়ন নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ভালোবাসা ও মনের মিলের ওপর। বিবাহের লক্ষ বাস্তবায়নে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর মিল-মহব্বতের প্রয়োজন; তা হাদীস দ্বারাও প্রমাণীত। হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা এমন মেয়েদেরকে বিবাহ কর, যাদের হৃদয়টা ভালোবাসার উচ্ছাসে ভরপুর থাকে এবং যে বংশের মেয়েদের বাচ্চা বেশি হয়। কেননা, আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের আধিক্য নিয়ে অন্য উম্মতদের সঙ্গে গর্ব করবো।’ কোনো কোনো বর্ণনায় ‘অন্য উম্মত’ এর স্থলে নবীগণের কথা এসেছে। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল) সন্তান লাভ করা বিবাহের একটা লক্ষ। সেই লক্ষে পৌঁছার জন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর ভালোবাসা। তাই রাসূল (সা.) ভালোবাসার কথা আগে বলেছেন; কারণ, তাছাড়া লক্ষ অর্জন হবে না।
বিবাহের লক্ষে পৌঁছার জন্য, যে সকল সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকা দরকার, এগুলো স্থাপনে দীনদারীর যতটুকু কর্তৃত্ব আছে, অন্যগুলোর এর সামান্যও নেই; এ জন্যে, হাদীসে পাত্র-পাত্রী খোঁজার ক্ষেত্রে দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া দীনদারী এমন এক গুণ যা পুরান হয় না, কিন্তু অন্যগুলো এক সময় নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে; বিশেষ করে সম্পদ ও সৌন্দর্য। তাই দীনদারীর গুণ দেখে বিয়ে করলে কখনো ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে না। কিয়ামতের দিন যখন কোনো সম্পর্কই থাকবে না, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের মাঝে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক সে দিন থাকবে না।’ (সূরা মুমিনুন, ১০১) সে দিনও দীনদারীর সম্পর্ক বহাল থাকবে। তাই দীনদারী দেখে বিবাহ করতে বলা হয়েছে।
দীনদারীর সঙ্গে সম্পদ ও সৌন্দর্য থাকলে সোনায় সোহাগা:
দীনদারীর সঙ্গে এগুলোও থাকলে সোনায় সোহাগা। এক হাদীস দ্বারা এর প্রমাণ মিলে। বর্ণনাটি হলো, ‘হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) এক মহিলাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। তারপর তিনি রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ওই মহিলা প্রসঙ্গে কথা বললেন। রাসূল (সা.) তাকে বললেন, তুমি ওই মহিলাকে দেখেছ? সে বললো- না। তিনি তখন বললেন, সম্ভব হলে বিবাহের আগে তাকে দেখে নাও। কেননা, দেখে নেয়া দ্বারা তোমাদের মাঝে ভালোবাসা স্থায়িত্ব লাভ করবে।’ (আল মুজামুল কাবীর) তাই কোনো রকম বাড়াবাড়ি ছাড়া সম্পদ ও সৌন্দর্য দেখে বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই।
বংশগত সমতা:
শেখ, সায়্যেদ, আনসারী এবং আলভী (হজরত আলী (রা.) এর বংশধর) এরা সকলে সমান। তারা ছাড়া বাকীরা সমশ্রেণীভূক্ত। তবে এদের মাঝে আগে মুসলমান হওয়ার গুরুত্ব রয়েছে। এই গুরুত্ব থাকবে পিতা ও দাদা পর্যন্ত। যেমন, কোনো ছেলে নিজে মুসলমান, কিন্তু তার বাপ-দাদা মুসলমান নয়, তাহলে সে ওই মেয়ের সমমান হবে না, যে মেয়ে নিজেও মুসলমান এবং তার বাপ-দাদাও মুসলমান। আর যে ছেলে নিজে ও তার বাপ-দাদা মুসলমান, কিন্তু পরদাদা মুসলমান নয়, সে ওই মেয়ের সমমান, যার পরদাদা ও তারও কয়েক পুরুষ উপর থেকে মুসলমান। (বেহেস্তি জেওর, বিবাহের সম্পর্ক স্থাপনে সমতা ও অসমতার অধ্যায়)
হজরত আশরাফ আলী থানবী (রাহ.) বংশগত সমতা আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘বিবাহে অনুচিত আরেকটা কাজ হলো, পাত্র-পাত্রীর সমতা খোঁজা ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। কেউ এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির শিকার হয় আবার কেউ একেবারে শিথিলতা করে ফেলে। বাড়াবাড়ি হলো, পাত্র সম্ভ্রান্ত বংশের হলে, আর কোনো কিছু দেখার প্রয়োজন মনে না করা। এ জন্য পাত্রের যোগ্যতা, দীনদারী, বয়স, শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা ইত্যাদি কোনোটাকেই ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ বিবাহের উপকার ও লক্ষগুলো বাস্তবায়নের জন্য শুধু বংশগত সম্ভ্রান্ততাই যথেষ্ঠ নয় বরং এগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অধিকন্তু বংশগত সম্ভ্রান্ততায় বাপ দাদার দিকে সম্পৃত্যতা ছাড়া পাত্রের আর কোনো কৃতিত্ব নেই। শুধু বংশগত বিষয় দেখার দ্বারা অনেক সময় একজন অযোগ্য, বেদীন, শারীরিক অক্ষম বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত, বেকার, বৃদ্ধ পাত্রের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া হয়; পরিণামে ওই পাত্রী সারাজীবনের জন্য একটা জেলে বন্দি হয়ে যায়। এ জন্যে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে।
অপরদিকে বংশগত বিষয়ে ছাড়াছাড়িও দেখা যায়। পাত্রের বংশগত কোনো সম্মান নেই কিন্তু দীনদারী বা জাগতিক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে বিয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, বংশগত কোনো মর্যাদা না থাকার দরুণ স্ত্রীর কাছে স্বামী কোনো পাত্তাই পায় না। এজন্য পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সংসার ভেঙ্গে যায়।’ (মাআরেফে হাকীমুল উম্মত, পৃষ্ঠা-৪৭৯)
অনারব পাত্র আরবী মেয়েকে বিবাহ না করা:
বংশগত মর্যাদার কারণে যেহেতু স্ত্রী স্বামীকে মানা নামানার বিষয় থাকে তাই অনারব পাত্র আরবী মেয়েকে বিবাহ না করা। কারণ, আরবরা অনারবদের মেনে নিতে পারে না।
পাত্র-পাত্রীর মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকা:
উত্তম হলো, পাত্র-পাত্রী দূরবর্তী বংশের হওয়া। কারণ, মেয়ে পূর্ব পরিচিত হলে, স্বামী-স্ত্রী সূলভ আচরণ পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া, কোনো কারণে তালাকের দ্বারা সম্পর্ক ছিন্ন হলে, আত্মীয়তার সম্পর্কও ঝুঁকিতে পড়ে যায়; অথচ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরী।
ভদ্র পরিবার খোঁজা:
অভিভাবকের করণীয় হলো, সভ্য, ভদ্র পরিবার, যার সদস্যদের স্বভাব-চরিত্র ও উত্তম গুণাবলীর সুনাম রয়েছে, পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের জন্য ঠিক করা। এর উপকার হলো, সন্তানরা স্বভাব-চরিত্র ও উত্তম গুণাবলী সহজে শিখতে পারবে। তাছাড়া, বিজ্ঞান ও প্রকৃতি দ্বারা পরীক্ষিত একটা বিষয় হলো, বাপ-মায়ের অনেক গুণাগুণ ওয়ারিস সূত্রে সন্তানাদি পেয়ে থাকে। হাদীস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইবনে আদীর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মেয়ে নির্বাচন করো। কেননা, মেয়ে তার ভায়ের মতো সন্তান জন্ম দেয়। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম শব্দে হাদীসটি ইবনে মাজাহ কিতাবেও বর্ণীত হয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, বিবাহে সমতার অধ্যায়, হাদীস নং১৯৬৮) শরহুল কাবীর কিতাবের একটা বক্তব্য দিয়ে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি, বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো মেয়েকে বিবাহ করতে চাও তখন তার বাপ-ভাইকে দেখো।’
পেশার ক্ষেত্রে সমতা:
কোনো কোনো ফকীহ পেশার ক্ষেত্রে সমতাকে অস্বীকার করেন। তাদের যুক্তি হলো, মানুষ যেকোনো মুহূর্তে নিম্ন মানের পেশা ছেড়ে, ভালো পেশা গ্রহণ করতে পারে। তাই বিবাহের ক্ষেত্রে পেশার বিষয়টা ধর্তব্য নয়। ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রাহ.) মতে বিবাহের পাত্র ঠিক করার ক্ষেত্রে পেশার সমতা দেখতে হবে। কোনো নিম্ন মানের পেশার লোক, ভালো ঘরের মেয়ের সমপর্যায়ের হতে পারে না। কারণ, ভালো পেশার পাত্র নিয়ে গর্ব করা হয়; নিম্ন পেশার পাত্র হলে তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়। (হিদায়, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩২১) এ জন্যে, কোনো কোনো ফিকহের কিতাবে মাসয়ালা লেখা হয়, তাঁতী, দর্জিদের সমান নয়। এমনিভাবে নাপিত-ধোপারাও দর্জিদের সমান নয়। (বেহেস্তি জেওর) মোটকথা, মেয়ের যোগ্যতা বুঝে, সেই বিবেচনায় সম্মানের পেশায় কর্মরত পাত্র ঠিক করা।
পাত্র-পাত্রী বয়সে কাছাকাছি হওয়া:
এ ব্যাপারে ‘আল ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল জাদীদ কিতাবের ভাষ্য হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময় দু’জনের বয়স কাছাকাছি থাকা উচিত। অতএব উচিত হবে না, যুবতি মেয়েকে বিবাহ দেয়া (যুবক ছেলেকে বিবাহ করানো) এমন লোকের সঙ্গে, যার বয়স কাছাকাছি নয়; দুজনের মাঝে বয়সের দিক থেকে অনেক বেশি পার্থক্য। যেমন পাত্র, মেয়ের বাপ বা দাদার সমপর্যায়ের। সফল বিবাহের পরিচয় হলো, যে বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী পরস্পর অশেষ ভালোবাসা ও হৃদয়ের টান তৈরি হয়। বর্তমান সময়ে এই পরিবেশ তৈরির জন্য দুজনের বয়স কাছাকাছি হওয়া অনেক সহায়ক। তাই কাছাকাছি বয়সের পাত্র-পাত্রী ঠিক করা উচিত। (আল ফিকহুল হানাফি ফী ছাওবিহিল জাদীদ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৫১)
স্বামীর সেবা করার আগ্রহী পাত্রী খোঁজা:
বর্তমান সময়ে অনকে অভিভাবক শিক্ষিত পাত্রী খোঁজেন। শিক্ষিত পাত্রী ভালো, তবে এর সঙ্গে স্বামীর সেবার বিষয়টিও খেয়াল করা। কারণ, অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মেয়েও যদি স্বামীর সেবা ও তাকে মেনে নিতে পারে তাহলে বিবাহের লক্ষ-উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যাবে। আর শিক্ষিত মেয়েও যদি স্বামীকে মানতে না পারে, তার সেবা না করে তাহলে আস্তে আস্তে সংসারে অশান্তি দেখা দিবে। তাই স্বামীর সেবা, তাকে মানার যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্রী খোঁজা প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব।