জানাযার আদব
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৫:১৪ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার
একজন মুসলমানের দায়িত্বে অন্য মুসলমানের যে হক রয়েছে, তার মধ্যে দুইটির বর্ণনা আগে আলোচনা করা হয়েছে। ১. সালামের উত্তর দেয়া। ২. অসুস্থ ব্যক্তির দেখাশুনা করা।
তৃতীয় হক : যা ওই হাদীসের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো জানাযায় অংশগ্রহণ করা এবং জানাযার সঙ্গে যাওয়া। এটা অনেক বড় ফজিলতের কাজ এবং মৃত ব্যক্তির হক। অবশ্য এই হক পুরুষের ওপর। মহিলাদের জন্য এ নির্দেশ প্রযোজ্য নয়। অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা পুরুষ মহিলা উভয়েরই কর্তব্য এবং অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার দ্বারা যে সওয়াব পুরুষের অর্জন হবে অবশ্যই ওই সওয়াব মহিলারও অর্জন হবে। কিন্তু জানাযার সঙ্গে যাওয়া শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। অবশ্য, মহিলারা সমবেদনার জন্য যেতে পারবে এবং আল্লাহ তায়ালার নিকটে এ আশা রাখবে যে, সমবেদনা প্রকাশ করার কারণে ওই সওয়াব অর্জন হবে।
জানাযার সঙ্গে যাওয়ার ফজিলত: হুজুর (সা.) জানাযার সঙ্গে যাওয়ার অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। একটি হাদীসে হুজুরে পাক (সা.) ইরশাদ করেন,
অর্থ: যে ব্যক্তি জানাযার সঙ্গে জানাযার নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকে সে একটি কিরাত সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে সে দুই কিরাত সওয়াবের অধিকারী হবে। কনো এক সাহাবী রাসূল (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল! এই দুই কিরাত কী রকম হবে? রাসূল (সা.) উত্তরে বললেন এই কিরাত দুটি, দুটি বড় পাহাড়ের সমপরিমাণ হবে। সর্বাবস্থায় জানাযার নামায পড়া এবং দাফন করা পর্যন্ত জানাযার সঙ্গে শরীক থাকা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
জানাযায় অংশগ্রহণের সময় নিয়ত কেমন হবে? জানাযার সঙ্গে অংশগ্রহণ করা বা জানাযার পেছনে যাওয়ার আমল এমন, যা আমরা সবাই কমবেশি করে থাকি। মনে হয় কোনো ব্যক্তি এমন নেই, যে কখনো জানাযায় অংশগ্রহণ করেনি। বরং সবাই কোনো না কোনো সময় এ কাজে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে এ আমল একটি প্রথায় পরিণত হতে চলেছে। যেমন: কিছু লোকের জানাযায় অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্য হলো এই যে, যদি জানাযায় অংশগ্রহণ না করে তাহলে সমাজ অসন্তুষ্ট ও মনোক্ষুণ হয়ে যাবে। এই নিয়ত এবং উদ্দেশ্য ভুল। এ জন্য জানাযায় অংশগ্রহণের সময় নিজের নিয়্যাত সঠিক করে নাও। এবং এই নিয়ত কর যে - আমি ওই মুসলমানের হক আদায় করার জন্য অংশগ্রহণ করব, আর জানাযায় অংশগ্রহণ করা তো হুজুর (সা.) এর সুন্নাত এবং তার আদেশ, এ জন্য আমি হুজুর (সা.) এর আনুগত্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে জানাযায় অংশগ্রহণ করব- এই নিয়তে যখন অংশগ্রহণ করবে তখন এই আমল অনেক বড় সওয়াবের উসিলা হয়ে যাবে।
জানাযা বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় কালিমায়ে শাহাদাত নয়: দ্বিতীয় বিষয় এই যে, জানাযায় অংশগ্রহণ করার পদ্ধতি সুন্নাত মোতাবেক হওয়া উচিত। অজ্ঞতা এবং অন্যমনস্কতার কারণে আমরা অনেক সুন্নতের উপর আমল করা থেকে বিরত থেকে যাচ্ছি এবং বিনা কারণে অগনিত সওয়াব নষ্ট করে দিচ্ছি। যদি সামান্য একটু সচেতন হতে পারি তাহলে একই আমলে অনেক সওয়াব অর্জন হয়ে যাবে। যেমন- সুন্নাত না জানার দরুণ আমাদের এখানে একটি রীতি প্রচলিত আছে যে, যখন জানাযাকে কাঁধে বহন করে নিয়ে যায় তখন একজন ব্যক্তি উঁচু আওয়াজে কালিমায়ে শাহাদাত পড়তে আরম্ভ করে, তার সঙ্গে অন্য ব্যক্তিরাও পড়তে শুরু করে-
أشهد أن لا إله إلا الله و أشهد أن محمدا عبده و رسوله -
এই পদ্ধতি একেবারেই ভুল। শরিয়তে এর কোনো প্রমাণ নেই। এই আমল না রাসূল (সা.) করেছেন, না সাহাবায়ে কেরাম (রা.) করেছেন এবং না আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন থেকে এই আমল বর্ণিত আছে।
বরং ফুকাহায়ে কিরাম লিখেছেন যে, জানাযা বহন করাকালীন কোনো প্রকারের যিকির উঁচু আওয়াজে পড়া বা উচ্চারণ করা মাকরুহ, এবং জানাযার সঙ্গে যাওয়ার আদব হলো- নিশ্চুপ অবস্থায় চলবে, প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলাও ভালো নয়। এই কারণে কালিমায়ে শাহাদাতের তাকবীর দেয়া অথবা কালিমায়ে শাহাদাত উঁচু আওয়াজে পড়া সুন্নাতের পরিপন্থী। এ থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
জানাযা উঠানোর সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করা: নীরব হয়ে চলার আদেশ এ জন্য যে, নীরব বা চুপ থেকে চিন্তা ও ধ্যান করা যে, যে অবস্থা আজ তার উপরে এসেছে সে অবস্থা একদিন তোমার উপরেও আসবে। এমন নয় যে, এই জানাযাকে তো তুমি নিয়ে গিয়ে কবরে দাফন করে দিবে এবং তুমি সর্বদা জীবিত থাকবে। এই কারণে চুপ থেকে তার মৃত্যুর কথা স্মরণ কর। একদিন তার মতো তোমাকেও মৃত্যু বরণ করতে হবে। এবং তোমারও জানাযা তার মতো উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এবং তোমাকেও কবরের মধ্যে দাফন করা হবে, এভাবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করার দ্বারা তোমার অন্তরের মধ্যে পরকালের প্রতি ভীতি সঞ্চার হবে এবং আল্লাহ তায়ালার দিকে মুতাওয়াজ্জু বা ধাবিত হওয়ার আকাঙ্খা সৃষ্টি হবে। এই জন্য চুপ থেকে মৃত্যুর কথা চিন্তা করা উচিত। আর যদি কোনো জরুরি কথা বলার প্রয়োজন হয়, তাহলে কথা বলবে। কথা বলা কোনো নাজায়েজ অথবা হারাম কাজ নয়, তবে আদবের খেলাফ হবে।
জানাযার আগে না চলা: একটি আদব হলো এই যে, যখন জানাযা নিয়ে যেতে থাকবে তখন জানাযা সামনে থাকা চাই, এবং লোকেরা তার পিছনে পিছনে চলবে। ডানে, বামে চলাও সঠিক। কিন্তু জানাযার আগে চলা ঠিক নয় বরং আদবের খেলাফ। অবশ্য কাঁধে বহন করার উদ্দেশ্যে সামান্য সময়ের জন্য জানাযার সম্মুখে চলে গেলে এতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু জানাযা কাঁধে নেয়ার জন্য কিছু লোক জানাযার সামনে দূর দূরান্ত পর্যন্ত এমন লম্বা সারি তৈরি করে যাতে জানাযার সঙ্গে চলার সকল লোক জানাযার সামনে চলে যায় আর জানাযা পিছে পড়ে যায়। এই পদ্ধতি কোনো মতেই ভালো নয়।
জানাযাকে কাঁধে নেয়ার পদ্ধতি: জানাযাকে কাঁধে নেয়ার পদ্ধতি হলো এই যে, সর্ব প্রথম মাইয়্যেতের ডান হাতের দিকের পায়া নিজের ডান কাঁধের উপর নিবে এবং কমপক্ষে দশ কদম চলবে। এটাই উত্তম, যদি দশ কদম চলার শক্তি থাকে। এই কারণে অন্য লোকদের এমন তাড়াহুড়া করা উচিত নয় যে, একজন জানাযা কাঁধে নিয়ে দাড়ানো মাত্রই দ্বিতীয় ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ সামনে অগ্রসর হয়ে তার নিকট থেকে জানাযা নিয়ে নিবে, এমনটি করা উচিত নয়। আর যদি কোনো ব্যক্তি শক্তিহীন, দূর্বল ও অসুস্থ হয় যে, দশ কদম খাটিয়া কাঁধে রাখাও তার জন্য কষ্টকর হয়, তাহলে তখন অন্য লোকদের উচিত তার থেকে তাড়াতাড়ি খাটিয়া নিয়ে নেয়া যেন তার কষ্ট না হয়। অতপরঃ মাইয়্যেতের ডান পায়ের দিকের পায়া নিজের ডান কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। এরপর মাইয়্যেতের বাম হাতের দিকের পায়া নিজের বাম কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। তারপর মাইয়্যেতের বাম পায়ের দিকের পায়া নিজের বাম কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। প্রত্যেক ব্যক্তিই জানাযার চারটি পায়াই বহন করতে কাঁধ দিবে এবং চল্লিশ কদম যাবে। এই পদ্ধতি সুন্নাতের অধিক নিকটবর্তী এবং উত্তম। যদিও তার পরিপন্থি করাও নাজায়েয নয়। এর পরিপন্থি হলে সুন্নাতের সওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে।
আজকাল জানাযা নিয়ে যাওয়ার সময় লোকেরা পরস্পরে ধাক্কা পাল্টা ধাক্কা দিতে থাকে। কাঁধ দেয়ার আগ্রহে যদি অন্য মুসলমান ভাইকে ধাক্কা দেয়া হয়, এই বিষয়ের প্রতি আমাদের কারো খেয়াল থাকে না যে, আমরা মুসলমানদের কষ্ট দিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত রয়েছি। কাঁধ দেয়ার সওয়াব নষ্ট করে উল্টা গুনাহ অর্জন করছি। এ জন্য এমনটি করা উচিত নয়। বরং ধীরস্থিরভাবে কাঁধ দেয়া চাই এবং অন্যকেও সুযোগ দেয়া চাই যেন, অন্য মুসলমান ভাই কাঁধে নিয়ে দশ কদম পূর্ণ করতে পারে। এর পরে চাইলে তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া যেতে পারে।
জানাযাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া: হুজুরে আকরাম (সা.) একটি হাদীসের মধ্যে জানাযাকে নিয়ে যাওয়ার এই আদব এরশাদ করেন যে, যখন তোমরা জানাযা নিয়ে যাও তখন সামান্য দ্রুত পদক্ষেপে অগ্রসর হও, আস্তে চলো না এবং এর কারণও বর্ণনা করেন যে, সে যদি জান্নাতি হয় তাহলে তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কেন দেরী করছো? তাকে তাড়াতাড়ি তার উত্তম ঠিকানায় পৌঁছে দাও। আর যদি সে দোযখী হয়- আল্লাহ মাফ করুন- তাহলে দোযখের উপযুক্তকে তাড়াতাড়ি তার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে নিজের কাঁধ থেকে ওই বোঝা দুর করে দাও। আবার এতোই দ্রুত করা উচিত নয়, যার কারণে জানাযা খাটিয়ায় নড়াচড়া করতে থাকে বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে চলো এবং তাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও।
জানাযা মাটিতে রাখা পর্যন্ত অবস্থান করা: এমনিভাবে একটি আদব এবং সুন্নাত হলো এই যে, কবরস্থানে যতক্ষণ পর্যন্ত লাশ কাঁধ থেকে নামিয়ে নিচে রেখে দেয়া না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত যেন কোনো লোক না বসে বরং দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যখন লাশ মাটিতে রাখা হবে তখন বসতে পারবে। হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থ বা দূর্বল হয় সে বসলে তাতে কোনো অসুবিধে নেই। অতএব সমস্ত আমল বা কাজে সুন্নাত এর অনুসরণ এর নিয়তে করবে এবং উহার এহতেমাম করবে। তাহলে সর্বাবস্থায় কৃত কাজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।