সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুনাফিকের পরিচয়: কোরআন-হাদিসের আলোকে

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

‘নিফাক’ ও ‘মুনাফিক’ আরবি দুটি শব্দ। ‘নিফাক’ অর্থ কপটতা এবং ‘মুনাফিক’ অর্থ কপট ব্যক্তি - যার অন্তরে এক, বাহিরে আরেক।

 ইসলামী পরিভাষায় ‘নিফাক’ এর অর্থ হলো, অন্তরে কুফরি গোপন রেখে মুখে ঈমানের কথা বলা এবং লোক দেখানোর জন্য বিভিন্ন ইসলামি ইবাদত পালন করা ও মুসলমানদের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। যে ব্যক্তি এরূপ করে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘মুনাফিক’ বলা হয়। নিফাক মূলত দুই প্রকার। ১. নিফাকে ইতিকাদি (বিশ্বাসগত নিফাক)। ২. নিফাকে আমলী (আমল-ইবাদতগত নিফাক)।

 

বিশ্বাসগত নিফাক কুফরের চেয়েও মারাত্মক। কারণ মুনাফিক ব্যক্তি বাহ্যত ইসলামের কাজ করে মুসলিম সমাজকে প্রতারিত করে এবং তাদের কাছ থেকে আইনগত আর্থিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আর শত্রুর গুপ্তচর হিসাবে কাজ করে এবং মুসলমানদের গোপন বিষয়ের ব্যাপারে দুশমনদের অবহিত করে দেয়। প্রকাশ্য শত্রু থেকে আত্মরক্ষা করা সহজ কিন্তু গোপন শত্রুর চক্রান্ত থেকে বাঁচা খুবই দুঃষ্কর। এই মুনাফিক সম্প্রদায়ের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

পবিত্র কোরআনে মুনাফিকের পরিচয়:
পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে মুনাফিকদের পরিচয় ও স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللّهِ وَبِالْيَوْمِ الآخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ

يُخَادِعُونَ اللّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلاَّ أَنفُسَهُم وَمَا يَشْعُرُونَ

فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ 

 

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ 

 أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشْعُرُونَ 

‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না। তাদের তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি, আর আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন। আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত : ৮-১২)

মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُواْ أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاء أَلا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاء وَلَـكِن لاَّ يَعْلَمُونَ

وَإِذَا لَقُواْ الَّذِينَ آمَنُواْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْاْ إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُواْ إِنَّا مَعَكْمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِؤُونَ

 

اللّهُ يَسْتَهْزِىءُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ

أُوْلَـئِكَ الَّذِينَ اشْتَرُوُاْ الضَّلاَلَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَت تِّجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُواْ مُهْتَدِينَ

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না। আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্রা। বরং আল্লাহই তাদের সাথে উপহাস করেন। আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে। তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত : ১৩-১৬)

হাদিসে মুনাফিকদের পরিচয়:
মুনাফিক কারা, কী তাদের বৈশিষ্ট্য? রাসূলুল্লাহ (সা.) তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন,
 
أربع من كن فيه كان منافقًا خالصًا، ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها: إذا حدث كذب، وإذا وعد أخلف، وإذا خاصم فجر، وإذا عاهد غدر

‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে মুনাফিক। আর যার মধ্যে এই স্বভাবগুলোর কোনো একটি পাওয়া যাবে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত সেও মুনাফিক বলে বিবেচিত হবে। স্বভাবগুলো হলো-

১. যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, 
২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, 
৩. ঝগড়া করলে গাল-মন্দ করে,
৪. প্রতিশ্রুতি দিলে বিশ্বাস ঘাতকতা করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪; মুসলিম, হাদিস : ৫৮)

 

অপর হাদিসে মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হল, “তার কাছে কোনো আমানত রাখলে খিয়ানত করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩ ; মুসলিম, হাদিস : ৫৯)

মুনাফিকরা ঈমান গ্রহণের দাবীতে মিথ্যাবাদী। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, 

وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ

‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয়ই মুনাফিকগণ মিথ্যাবাদী।’ (সূরা মুনাফিকূন, আয়াত : ১)

এছাড়া মুনাফিকদের পরিণাম হবে জাহান্নামের নিন্মতম স্তর। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا

‘নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে, তোমরা তাদের জন্য কখনো কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১৪৫)

পবিত্র কোরআন মাজিদের বহু আয়াতে মুনাফিকদের অপতৎপরতা ও অপকর্মের বর্ণনা রয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে একটি সূরাও নাজিল হয়েছে। কাজেই মুনাফিকদেরকে চেনা এবং তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকা মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে মুনাফিকদের থেকে হেফাজত করুন। আল্লাহু্মা আমিন।